IQNA

ইসলামপূর্ব আরব সমাজে পবিত্র মক্কা নগরীর অনন্য বৈশিষ্ট্য

0:02 - November 18, 2023
সংবাদ: 3474672
তেহরান (ইকনা): ইসলাম আগমনের আগে আরব উপদ্বীপে কেন্দ্রীয় কোনো শাসন ছিল না। তবে ছোট ছোট আঞ্চলিক বেশ কয়েকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এর উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে। তবে আরব উপদ্বীপের মূল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হিজাজ ছিল সব ধরনের রাজনৈতিক কাঠামো, রাজনৈতিক প্রভাব ও আধিপত্যের বাইরে। রাজনৈতিক কাঠামোর বিচারে ইসলামপূর্ব আরবকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত করা যায় : আরব উপদ্বীপের উত্তরাংশ, আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাংশ ও হিজাজ।

ইসলামপূর্ব যুগে উল্লিখিত তিন অঞ্চলের রাজনৈতিক কাঠামো ও প্রকৃতি কেমন ছিল তা এখানে তুলে ধরা হলো।
 
 
আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাংশে সুপ্রাচীন কাল থেকে কয়েকটি রাজ্য ছিল, যেগুলোর বেশির ভাগ খ্রিস্টপূর্ব যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে এসব রাজ্য সম্পর্কে খুব বেশি ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণ পাওয়া যায় না। তা থেকে ধারণা করা হয়, রাজ্যগুলো রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ছিল না।
 
ইসলামপূর্ব যুগে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাংশে গড়ে ওঠা কয়েকটি রাজ্যের বিবরণ নিম্নরূপ :
১. মুয়াইয়িন রাজ্য : খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৬৩০ সাল পর্যন্ত তারা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চল শাসন করে। তবে এটা ছিল একটি আশ্রিত রাজ্য। বড় রাষ্ট্রের ছায়ায় দেশ পরিচালনা করত। কখনোই তারা স্বাধীন ছিল না।
 
রাজ্যটি কখনো একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে আবার কখনো অভিজাত পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে।
২. সাবা রাজ্য : আরব অঞ্চলের প্রভাবশালী রাষ্ট্র ছিল সাবা। ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে এই রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। পরে মুয়াইয়িন রাজ্যসহ আঞ্চলিক রাজ্যগুলোকে অধীন করতে সক্ষম হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০ থেকে ১১৫ সাল পর্যন্ত সাবা রাজ্য টিকে ছিল।
 
পবিত্র কোরআনের সুরা সাবা ও নামলে এই রাষ্ট্রের আলোচনা এসেছে। কোরআনের আলোচনা থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্রটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল।
৩. হামির রাজ্য : ইয়েমেনের সাবা অঞ্চল এবং লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে হামির রাজ্য গড়ে উঠেছিল, যা খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ থেকে ৬৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। রাজ্যটি সাবা ও রাইদান অঞ্চলকে জয় করে এবং পারস্য ও হাবশার সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
 
উত্তর আরবের রাজনৈতিক কাঠামো
 
আরব উপদ্বীপের উত্তরাংশেও কয়েকটি ছোট রাজ্য গড়ে উঠেছিল। যেমন :
 
১. মানাজিরা রাজ্য : ইয়েমেন থেকে লাখমসহ কয়েকটি গোত্র আরব উপদ্বীপের উত্তরাংশে এসে বসতি স্থাপন করে। তারা সেখানে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। হিরা নগরী ছিল তাদের রাজধানী। রাজ্যটি পারস্য সম্রাটের অধীন ছিল। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে মানাজিরা রাজ্যের যাত্রা শুরু হয় এবং ইসলাম আগমনের আগ পর্যন্ত তা টিকে ছিল। আরব রাজ্যগুলোর মধ্যে তারাই ছিল সবচেয়ে শিক্ষিত ও সভ্য। প্রাচীন আরবে মানাজিরদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে প্রবল।
 
২. গাসসানিয়া রাজ্য : ইয়েমেন থেকে কয়েকটি গোত্র হিজরত করে উত্তর-পশ্চিম আরব তথা জর্দান ও দক্ষিণ সিরিয়ায় বসতি স্থাপন করে। তারা গাসসানিয়া নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। গাসসানি শাসকরা রোমান শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে রাজ্য পরিচালনা করত। গাসসানিদের রাজ্যে আরব-রোমান সংস্কৃতির মিশ্রণে নতুন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
হিজাজের রাজনৈতিক কাঠামো
 
ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে আরবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল হিজাজ। পবিত্র কাবাসহ আরবের প্রসিদ্ধ কয়েকটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিজাজে অবস্থিত ছিল। এ ছাড়া এখানে প্রভাবশালী কয়েকটি আরব গোত্র বাস করত। হিজাজে প্রচলিত কোনো রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কাঠামো ছিল না। কোনো বিচারব্যবস্থা বা আইনি কাঠামোও সেখানে ছিল না। কোনো বহিরাগত শক্তি, রাষ্ট্র বা সেনাবাহিনী হিজাজ কখনো পদানত করতে পারেনি। তবে সেখানে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির জন্ম হয়, যাঁরা আপন আপন গোত্রের অধিপতি ছিলেন।
 
ব্যতিক্রম মক্কা
 
সমগ্র হিজাজে কোনো সুসংহত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থাকলেও ব্যতিক্রম ছিল পবিত্র মক্কা নগরী। কেননা পুণ্যার্থীদের সেবা ও কাবাঘরের ব্যবস্থাপনা সুন্দর করতে এখানে একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে। এই কাঠামো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদন করত। যেমন :
 
১. হিজাবা : এর অধীনে ছিল কাবাঘর পাহারা দেওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ কাবাঘরের দরজা খুলতে পারত না।
 
২. সিকায়া : এর অধীনে ছিল হাজিদেরকে জমজমের পানি পান করানো। জমজমের পানির সঙ্গে তাদেরকে খেজুর ও কিশমিশও দেওয়া হতো। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই দায়িত্ব আব্বাস (রা.) ও তাঁর সন্তানরা পালন করতেন।
 
৩. রিফাদা : রিফাদা হলো আপ্যায়ন। কুসাই বিন কিলাবের সময় থেকে কুরাইশ গোত্র হজের সময় হাজিদের আপ্যায়নে খাবারের ব্যবস্থা করত। কুরাইশের নির্ধারিত শাখা এই দায়িত্ব পালন করত।
 
গোত্রীয় শাসনের কাঠামো
 
কেন্দ্রীয় শাসন না থাকলেও হিজাজে গোত্রীয় শাসন বিদ্যমান ছিল। গোত্রীয় শাসনকাঠামোতে প্রতিটি গোত্র, তার শাখা-উপশাখা ও পরিবারকে একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। একজন গোত্রপ্রধান এবং গোত্রীয় নেতাদের সম্মিলিত নেতৃত্বে তারা পরিচালিত হতো। গোত্রের শাখা বড় হয়ে গেলে তার স্বতন্ত্র গোত্র হিসেবে নিজস্ব কাঠামোতে পরিচালিত হতো।
 
প্রতিটি গোত্র নিজস্ব নিয়ম-নীতি ও অনুশাসন মেনে চলত। তারা জীবিকা নির্বাহ ও সামাজিক কল্যাণে পরস্পরকে সহযোগিতা করত। বিশেষত শত্রুর মোকাবেলা এবং বন্ধুর সহযোগিতা সম্মিলিতভাবে সম্পন্ন করত। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিজাজের গোত্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে হালাফ বা বন্ধু চুক্তিতে আবদ্ধ হতো। প্রতিটি গোত্র তার বন্ধু গোত্রের নিরাপত্তা ও রক্তের দায় গ্রহণ করত।
 
আন-নিজামুস সিয়াসি ফিল ইসলাম অবলম্বনে
captcha